বুলেট-বোমা তুচ্ছ করে বইয়ের কাছে
একটি জায়গা যখন বছরের পর বছর ধরে অবরুদ্ধ, ক্ষুধা যেখানে পথে-প্রান্তরে ছড়িয়ে, সেখানকার মানুষের বইয়ের প্রতি আগ্রহ খুব সামান্যই থাকার কথা। কিন্তু সিরিয়ার ভূগর্ভস্থ পাঠাগারটি সে কথা বলে না। সেখানে মনের খোরাক জোগাতে রয়েছে রাশি রাশি বই। বইপাগল পাঠকেরা বুলেট ও বোমাকে তুচ্ছ করে এই বইয়ের টানে পাঠাগারে যাচ্ছে নিয়মিত।
বোমা ও শেলের উড়ন্ত টুকরো, চোরাগোপ্তা হামলাকারীদের ছোড়া বুলেট এড়িয়ে পৌঁছাতে হয় সেই পাঠাগারে। এক সোপান খাড়া সিঁড়ি ভেঙে নিচে নামার পর মৃদু আলোতে ভরা একটি বড়সড় ঘরে সেই পাঠাগার।
পাঠাগারটি গড়ে তোলার উদ্যোক্তাদের একজন আনাস আহমাদ। তিনি পুরকৌশলে পড়াশোনা করেছেন। এমন একটি পাঠাগার গড়ে তোলার কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমরা দেখলাম যে নতুন একটি পাঠাগার গড়ে তোলা আমাদের খুব দরকার। তাহলে আমরা পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারব। বোমা আর শেলের আঘাতে এটি যাতে ধ্বংস হয়ে না যায়, এ জন্য এটি মাটির নিচে গড়ে তোলা হয়।’
ছোট্ট মেয়ে ইসলাম পাঠাগার থেকে আনা বই পড়ছে মায়ের সঙ্গেপ্রায় চার বছর আগে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের অনুগত সেনারা দারাইয়া অবরোধ করেন। সেই তখন থেকে আনাস ও স্বেচ্ছাসেবকেরা ১৪ হাজারের বেশি বই সংগ্রহ করেন। প্রতিটি বিষয়ে তাঁদের বইয়ের সংগ্রহ অকল্পনীয়। যুদ্ধের কারণে পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যাওয়া শিক্ষার্থীদের অনেকে এই পাঠাগারের জন্য স্বেচ্ছাশ্রম দিচ্ছেন।
এই চার বছরে সেখানে দুই হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। এদের মধ্যে অনেক বেসামরিক ব্যক্তি রয়েছেন। কিন্তু তা আনাস এবং তাঁর বন্ধুদের এ কাজে দমিয়ে রাখতে পারেনি। পাঠাগারের বইয়ের তাক পূর্ণ করতে বইয়ের সন্ধানে তাঁরা বিধ্বস্ত সড়কগুলো চষে বেড়াচ্ছেন।
আনাস বলেন, ‘এমনও হয় যে বোমা ও গোলার আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত বাড়িগুলোতে আমরা বই পাই। সে ক্ষেত্রে বেশির ভাগ জায়গা যুদ্ধের সম্মুখভাগ। তাই সেখান থেকে বই সংগ্রহ করা বেশ বিপজ্জনক।’ তিনি আরও বলেন, ‘বন্দুকধারীদের গুলি থেকে বাঁচতে, বোমার আঘাত এড়াতে লুকিয়ে লুকিয়ে আমাদের বই জোগাড়ে যেতে হয়।’
আনাস ও পাঠাগার ব্যবহারকারীরা স্থানটি গোপন রেখেছেন। তাঁদের ভয়, দারাইয়ায় হামলাকারীরা স্থানটির সন্ধান পেয়ে গেলে হয়তো এটাও তাদের হামলার লক্ষ্যস্থলে পরিণত হবে।
পাঠাগারের ওই স্থানটি শিশুদের জন্য খুব বিপজ্জনক। এরপরও অনেক শিশু সেখানে যায়। ছোট্ট একটি মেয়ে বলল, সে বেশির ভাগ সময় বাড়ির ভেতরে থাকে। ক্ষুধার যন্ত্রণা থেকে বাঁচতে বাড়িতেই সে খেলা করে আর পাঠাগার থেকে বন্ধুদের আনা বই পড়ে।
যোদ্ধা ওমর অপেক্ষার সময়গুলোতে এভাবেই বই পড়েনআমজাদ নামের ১৪ বছরের একটি কিশোর প্রতিদিনই ওই পাঠাগারে যায়। পাঠাগারে থাকা তার কাছে বেশি নিরাপদ বলে মনে হয়। এর বাইরে বইয়ের প্রতি তাঁর তৃষ্ণা তাকে ওই পাঠাগারের ‘সহকারী গ্রন্থাগারিক’-এর দায়িত্ব পালনের মর্যাদা দিয়েছে।
যুদ্ধবিধ্বস্ত শহরে বইয়ের চেয়ে খাবারের সন্ধানে সময় ব্যয় করা কি বেশি যৌক্তিক নয়? এমন প্রশ্নের জবাবে পাঠাগারের নিয়মিত আরেক পাঠক ২০ বছর বয়সী সাবেক শিক্ষার্থী আবদুল বাসেত আলাহমার বলেন, ‘মস্তিষ্ক পেশির মতো। পড়ার মাধ্যমে তা আমাকে শক্তিশালী করছে। আমার আলোকিত মস্তিষ্ক এখন আমার আত্মার খোরাক জোগাচ্ছে। এই পাঠাগারটি আমাকে আবার জীবনে ফিরিয়ে এনেছে।’
ওমর আবু আনাস নামের আরেক যুবকও এই পাঠাগারের নিয়মিত পাঠক। তিনিও প্রকৌশলে পড়েছেন। ওমর তাঁর শহর রক্ষার জন্য নিযুক্ত এক যোদ্ধা। যুদ্ধের সম্মুখভাগে তাঁকে থাকতে হয়। সে সময় তিনি সঙ্গে প্রচুর বই রাখেন। দেখা যায়, ওই সময় তাঁর এক হাতে বন্দুক, আরেক হাতে থাকে বই। বিবিসি নিউজ অবলম্বনে
Like this:
Like Loading...