ঠিক এক সপ্তাহ আগে, গত বুধবার, ইউনাইটেড হাসপাতালে তাঁকে দেখতে গিয়ে চমকে উঠেছিলাম। এই কি আমাদের সদা ঝকঝকে হক ভাই? কর্কট রোগ আর তার চিকিৎসার ধকলে ধ্বস্ত শরীর। ডান চোখের চারপাশে গাঢ় হয়ে বসেছে কালশিটে। শয্যা ঘিরে বিচিত্র নল।
বললাম, হক ভাই, কবিতার বই নিয়ে কথা হবে না? জবাব দিতে যখন মুখ খুললেন, সেই চিরচেনা সৈয়দ হক। প্রখর রৌদ্রালোকের মতো কণ্ঠস্বরে অবিকল সেই আগের তীব্রতা। বরং তার চেয়েও বেশি। বললেন, ‘হ্যাঁ, কথা তো অবশ্যই হবে, শিগগিরই; বেন্টোবক্স খেতে খেতে।’
১৯৮৭ সালে যাত্রাশিল্পী অমলেন্দু বিশ্বাস গত হওয়ার পর এক ব্যক্তিগত চিরকুটে তিনি লিখেছিলেন, ‘আমাকে তুমি বলার লোক ক্রমশ কমে আসছে।’ দেশের বাইরে থেকে বাইপাস অপারেশন করে এসেছিলেন ১৯৮৮ সালে। এই অস্ত্রোপচারের অভিজ্ঞতা দেশে তখনো বিরল। বলেছিলেন, ‘এখন আর চার-পাঁচ বছর বাঁচলেও যথেষ্ট।’
এরপর আরও প্রায় তিনটি দশকজুড়ে তিনি বেঁচে ছিলেন বিপুলভাবে; বিচিত্র সৃষ্টিশীলতায় আমাদের ভরিয়ে দিয়ে। কর্কট রোগের চিকিৎসার জন্য শেষবার লন্ডনযাত্রার আগেই বোধ করি মৃত্যুর আহ্বান শুনতে পেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু সেটিকে মোটেই গ্রাহ্য করেননি। বলেছিলেন, ‘আমার আরও বেশ কিছু লেখা বাকি। একটা নাটক, একটা কাব্যগ্রন্থ, দুটো উপন্যাস, আত্মজীবনীর আরও একটি পর্ব।’ মৃত্যুশয্যায় তিনি উপচে উঠেছিলেন সৃষ্টিশীলতার জোয়ারে। একটি মুহূর্ত খোয়ানোর মতোও তর সইছিল না তাঁর। লিখে গেছেন কবিতা, গান, ছোটগল্প, নাটক। একটার পর একটা, অবিরল। যতক্ষণ পেরেছেন, লিখেছেন নিজের হাতে। যখন আর পারেননি, মুখে মুখে বলে গেছেন। তাঁর স্ত্রী, লেখক-চিকিৎসক আনোয়ারা সৈয়দ হক, টুকে নিয়েছেন কাগজে।
সৈয়দ শামসুল হকের উঠে আসার পথ যেন-বা পূর্ববঙ্গের বাঙালির ইতিহাসের এক প্রতীকী রেখাচিত্র। দাদা সৈয়দ রইসউদ্দিন নিয়েছিলেন ফকিরি। যাযাবর হয়ে কুড়িগ্রামের নিজ ভিটা ছেড়ে দীর্ঘদিনের জন্য বেরিয়ে যেতেন দূরদূরান্তের মুরিদদের কাছে। বাবা সৈয়দ সিদ্দিক হোসাইন ধরলেন ভিন্ন পথ, হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা। বইও লিখলেন নিজের পেশাকে বিষয় করে। সেই ১৯৩৫ সালের ২৭ ডিসেম্বর কুড়িগ্রামে জন্ম নিয়েছিলেন যে সৈয়দ শামসুল হক, তাঁর মধ্যে জেগে উঠল আরও ভিন্নতর এক তৃষ্ণা—সাহিত্যের বেদনা। তরুণ বয়সে বাবাকে হারিয়ে মা হালিমা খাতুনকে সঙ্গে নিয়ে এলেন নবীন রাজধানী ঢাকায়। নতুন এক ইতিহাসের ভেতর অভিষেক ঘটল তাঁর। ১৯৫০-এর দশকে ইতিহাস নতুন খাতে বইতে শুরু করেছে, যা তার গন্তব্য হিসেবে একটি স্বাধীন দেশের স্বপ্ন দেখতে শুরু করবে।
সৈয়দ শামসুল হকের মধ্যে সৃষ্টিশীলতার যে তৃষ্ণা জেগে উঠেছিল, তা রেনেসাঁ-মানবদের মতো। তিনি সক্রিয়ভাবে জড়ালেন সাহিত্যকর্মে, কিন্তু তাঁর আগ্রহ উপচে পড়ল আরও নানা শিল্পমাধ্যমে। চলচ্চিত্র, গান, শিল্পকলায়।
১৯৫১ সালে বাড়ি থেকে পালিয়ে চলে গিয়েছিলেন চলচ্চিত্র-নগরী বোম্বেতে। ভিড়ে গিয়েছিলেন চলচ্চিত্রকার কামাল আমরোহির নির্মাতা দলের তরুণ সদস্য হয়ে। দেশে ফিরেও এলেন ১৯৫২ সালে। আরও কিছু পরে, ঢাকার চলচ্চিত্রের উন্মেষের যুগে, হয়ে পড়লেন এক স্বপ্নদলের সঙ্গী। মাটির পাহাড় নামে একটি ছবি হবে—তার গান লিখলেন শামসুর রাহমান, সংগীত পরিচালনায় সমর দাশ, আর চিত্রনাট্য লিখলেন সৈয়দ হক। এরপরও জড়িয়ে থাকলেন আরও কত ছবির কাহিনি, চিত্রনাট্য আর গান রচনায়। কথায় কথায় বহুবার বলেছেন, তিনি গান লিখতে চাননি। তবু কত-না জনপ্রিয় গান তাঁর হাত থেকে বেরোল।
বন্ধু-চিত্রশিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীর কাছ থেকে নিবিষ্টভাবে জেনেছিলেন চিত্রকলার ব্যাকরণ। খেলাচ্ছলে এঁকেছিলেন ছবি। হাত লাগিয়েছিলেন শৌখিন স্থাপত্য রচনায়।
তবু সৈয়দ শামসুল হকের আসল ক্ষেত্র ছিল সাহিত্য। সাহিত্যের সব মাধ্যমে নিজেকে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন, এটুকু বললে তাঁর সম্পর্কে অল্পই বলা হবে। কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক, আত্মজীবনীর বাইরেও নিজেকে প্রকাশের তীব্রতায় অবিরত আবিষ্কার করেছেন লেখার নতুন নতুন ধরন।
এ যুগে অচল মহাকাব্যের ধাঁচে লিখেছেন বৈশাখে রচিত পঙ্ক্তিমালা। বড় দ্বিধায়, ছদ্মনামে, শুরু করেছিলেন পরানের গহীন ভিতর-এর পুরো আঞ্চলিক ভাষায় লেখা কবিতাগুলো। তা-ই পাঠক গ্রহণ করল সাদরে। রজ্জুপথে চলেছি বইয়ের দীর্ঘ কবিতায় ধরে রাখলেন ঢাকা নগরীর একটি কালের হৃৎস্পন্দন। কথাসাহিত্যেও বিচিত্র এক জগৎ রচনা করেছিলেন সৈয়দ হক। ‘জলেশ্বরী’ নাম দিয়ে উত্তরবঙ্গের এক স্বতন্ত্র ভূখণ্ড গড়ে তুলেছিলেন গল্পে আর উপন্যাসে। তবে তাঁর প্রতিভা শিখরে পৌঁছেছিল নাটকে। আরও নির্দিষ্ট করে বললে কাব্যনাটকে, যেখানে তাঁর কাহিনি বলার দক্ষতায় এসে মিশেছে কবিতার কুশলতা। পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় ও নূরলদীনের সারাজীবন সম্ভবত তাঁর শ্রেষ্ঠতম কীর্তি। নূরলদীনের সারাজীবন-এর সংলাপ ‘জাগো বাহে, কোনঠে সবায়’ ধীরে ধীরে হয়ে উঠল মৃত্যু-পেরোনো এক আবাহন।
কর্কট রোগের চিকিৎসা নিতে এ বছরের মাঝামাঝি অনেকটা দিন দেশের বাইরে থাকতে হয়েছিল তাঁকে। কিন্তু দেশে ফেরার জন্য সৈয়দ শামসুল হক আকুল হয়ে উঠেছিলেন। সেখান থেকে পাঠানো এক খুদে বার্তায় ঝরে পড়েছিল সেই আর্তি। লিখেছিলেন, ‘রয়্যাল মার্সডেন হাসপাতালে কাল থেকে চিকিৎসা শুরু হবে। অসম্ভব ব্যথা। অস্থির লাগছে। গৃহকাতরতা চেপে বসেছে।’
সৈয়দ শামসুল হক দেশে ফিরলেন। শারীরিকভাবে চলেও গেলেন। কিন্তু মৃত্যুকে অগ্রাহ্য করে আমাদের মধ্যে রয়েই গেলেন।
# | Cases | Deaths | Recovered |
---|---|---|---|
World | 0 | 0 | 0 |
Bangladesh | 0 | 0 | 0 |
Data Source: worldometers.info |
বর্তমানে করোনা ভাইরাসের জন্য খবরের শিরোনামে রয়েছে চিন। এই দেশেরই এক শহরে প্রথম এই ভাইরাস পাওয়া গিয়েছিল, ...
বিস্তারিতলক ডাউনের মধ্যে পরিচিতদের সঙ্গে কথা বলার অন্যতম মাধ্যম হয়ে উঠেছে ভিডিও কল। আর সেই কারণে ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে ...
বিস্তারিতনিউইয়র্ক: কান ঘেঁষে না হলেও পাশ ঘেঁষে তো বটেই। কেটে গেল ফাঁড়া। পৃথিবীর পাশ কেটে বেরিয়ে গেল প্রায় ২ কিলোমিটার ...
বিস্তারিতকরোনাভাইরাসের সংক্রমণের শিকার হওয়া নতুন রোগী শনাক্তে অভিনব ব্যবস্থা নিয়েছে চীন সরকার। সম্প্রতি দেশটির কিছু ...
বিস্তারিত