জঙ্গি-সন্ত্রাস-হত্যাকাণ্ডের পাশাপাশি ‘রামপাল-সুন্দরবন-বিদ্যুৎকেন্দ্রও আমাদের অন্যতম আলোচনার বিষয়। বিদ্যুৎ উৎপাদন, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, প্রযুক্তি- এগুলো জটিল বিষয়। সাধারণ জনমানুষের কাছে অনেক ক্ষেত্রেই এই জটিলতা ‘দুর্বোধ্য’ মনে হওয়ার কথা। আবার বিষয়টি জনজীবনের সঙ্গে অত্যন্ত সম্পৃক্ত বিধায়, সব মহলের আলোচনাতে কোনও না কোনওভাবে থাকছে। চলছে তর্ক-বিতর্ক। এসব বিতর্কে তথ্যের চেয়ে রাজনৈতিক গোঁড়ামি প্রাধান্য পেতে দেখা যায়।
এই জটিল বিষয়টি অত্যন্ত সরল ব্যাখ্যা করার একটা চেষ্টা, আজকের এই লেখা।
১. পৃথিবীতে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র তিন ধরনের প্রযুক্তি দিয়ে পরিচালিত হয়।
ক. সাব ক্রিটিক্যাল
খ. সুপার ক্রিটিক্যাল
গ. আলট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল
বর্তমানের সবচেয়ে আধুনিক প্রযুক্তি ‘আলট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল’। ভারতের অধিকাংশ কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র সাব ও সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তির। কিছু আলট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তির। এশিয়ার উন্নত দেশ, ইউরোপ, আমেরিকার প্রায় সব কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র আলট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তিনির্ভর। বাংলাদেশে সুন্দরবনের পাশে ‘রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র’ পরিচালিত হবে আলট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তিতে।
২. সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের কারণে পরিবেশ দূষণ হবে না। কারণ এই প্রকল্পে ব্যবহার করা হবে ‘আলট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল’ প্রযুক্তি। বিতর্ক বা গলদ এখানেই। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চলবে আর পরিবেশ দূষণ হবে না- এমন প্রযুক্তি আজ পর্যন্ত পৃথিবীতে আবিষ্কার হয়নি। কোনওদিন আবিষ্কার হবে, তারও সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।
‘সাব’ থেকে ‘আলট্রা’- দূষণের পরিমাণ কমানো গেছে। কম কয়লা পুড়িয়ে সমপরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়। সাব ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তিতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের দক্ষতা ৩৭%, সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তিতে ৩৯%, আর আলট্রা সুপার
ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তিতে ৪২%।
‘সাব’ বা ‘সুপার’র চেয়ে ‘আলট্রা সুপার’ ক্রিটিক্যালে যেহেতু কয়লা কিছু পরিমাণ কম পোড়াতে হয়, ফলে দূষণও কিছুটা কম হয়। সেই দূষণ কমের পরিমাণ কম-বেশি ২% থেকে ৫%। আরও সহজ করে বলি- সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তি ব্যবহার করে যে পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন করলে ১০০ টন বিষাক্ত সালফার ডাই অক্সাইড নির্গত হবে, আলট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তি ব্যবহার করলে তা ১০ টন কমবে। অর্থাৎ ১০০ টনের জায়গায় ৯০ টন বিষাক্ত সালফার ডাই অক্সাইড বের হবে। ১০ টন কম মানে পরিবেশ দূষণ একটু কম। ‘আলট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল’ প্রযুক্তি ব্যবহার করব, কোনও দূষণ হবে না, সুন্দরবনের ক্ষতি হবে না- যা সম্পূর্ণ ‘অসত্য’ এবং বাস্তবতা বিবর্জিত কথা।
৩. সরকারের পরিবেশ সমীক্ষা অনুযায়ী রামপাল কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু হলে প্রতিদিন ১৪২ টন বিষাক্ত সালফার ডাই অক্সাইড, ৮৫ টন বিষাক্ত নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইড নির্গত হবে। বছরে ৯ লাখ টন অত্যন্ত ক্ষতিকর বিষাক্ত ছাই বাতাসে মিশবে। সরকারের এই হিসেব কিন্তু ‘আলট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল’ প্রযুক্তিকে বিবেচনায় নিয়েই। সুন্দরবনের ১০ কিলোমিটার দূরে বিষাক্ত সালফার, নাইট্রোজেন, ছাই উৎপন্ন হবে, আর সুন্দরবনের ক্ষতি হবে না? এই বিষাক্ত জিনিসগুলো যাবে কোথায়? এই প্রশ্নের উত্তর নেই, আছে শুধু ‘ক্ষতি হবে না, ক্ষতি হবে না’ তথ্যহীন বক্তব্য।
৪. ‘আলট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল’ প্রযুক্তির কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিষাক্ত কার্বন ডাই অক্সাইড, সালফার ও নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইড, পারদ, সিসা, আর্সেনিক মিশ্রিত বিষাক্ত ছাই নির্গত হয়। রামপাল কয়লা
বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকেও এর সবই নির্গত হবে।
রামপালের পাশের পশুর নদী থেকে পানি তুলতে হবে, গরম পানি ফেলতে হবে- নদীর পানি, জলজ জীব বৈচিত্র্যের ক্ষতি হবেই। ভারতের যেসব জায়গায় কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র আছে, সেসব জায়গার নদী-খাল-পানি দূষণ হয়, পরিবেশেরও ক্ষতি হয়। বহু উদাহরণ ইচ্ছে করলে এই লেখাতেও দেওয়া যায়।
৫. ক্ষতি হওয়ার পরও তাহলে ভারতে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র কেন নির্মাণ করা হয়েছে? এখনও কেন নির্মাণ করা হচ্ছে? বাংলাদেশে হলে সমস্যা কী? উন্নয়নের জন্য বিদ্যুৎ অপরিহার্য। কিছু ক্ষতি মেনে নিয়েই কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হয়। ভারতও তাই করেছে।
বাংলাদেশেরও বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করতে হবে। এটা নিয়ে কোনও বিতর্ক বা আপত্তি নেই। আপত্তি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ নিয়ে নয়। আপত্তি রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ নিয়ে। কারণ রামপালের পাশে সুন্দরবন। বিদ্যুতের চেয়েও সুন্দরবন অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। বিদ্যুৎকেন্দ্র রামপাল ছাড়াও আরও অনেক জায়গায় নির্মাণ করা যায়। একাধিক নির্মাণ করা যায়। নির্মাণ করতে হবে। কিন্তু সুন্দরবন পৃথিবীতে একটিই। আর একটি সুন্দরবন যেহেতু বানানো যাবে না, সুতরাং সুন্দরবন ধ্বংস বা ক্ষতিও করা যাবে না।
৬. সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে কয়লা পরিবহনের জন্য জাহাজ চলবে। শব্দ ও আলোক দূষণ হবে। বলা হচ্ছে জাহাজে আনা কয়লা এমনভাবে ঢেকে আনা হবে, যা সুন্দরবনের ভেতরে নদীতে পড়বে না। বড় জাহাজ থেকে ছোট জাহাজে করে
সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে কয়লা ঢেকে আনার তত্ত্বটি সম্পূর্ণ অবাস্তব। ভারতের কয়লা পরিবহনের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায়, খোলা ট্রেনে করে কয়লা পরিবহন করা হয়। তখন বাতাসে দূষণ ছড়িয়ে পড়ে। ভারতীয় কোম্পানি ভারতে যা করে না, বাংলাদেশে তা করবে- যা কোনওভাবেই বিশ্বাসযোগ্য কথা নয়।
৭. আমাদের দেশের অনেক বিশেষজ্ঞ, সংবাদ কর্মীর ভারতের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র দেখার সুযোগ হয়েছে। তাদের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, পরিবেশ দূষণ বিষয়ে যা এই লেখায় বলা হলো, তার সবই সেসব কেন্দ্র থেকে হয়।
জার্মানির কোলনের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটি অনেকবার আলোচনায় এসেছে। প্রশ্ন রাখা হয়েছে, পরিবেশের ক্ষতি হলে জার্মানি কী কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করত?
কোলনের এই বিদ্যুৎকেন্দ্রটি আমার নিজের দেখার সুযোগ হয়েছে। যেখানে বিদ্যুৎকেন্দ্র তার আশপাশে বিশাল এলাকায় কোনও জনবসতি নেই। যারা ছিলেন তাদের সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। এই এলাকায় জীববৈচিত্রে ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। ঠিকমতো বৃষ্টি হয় না, ফসল হয় না। বিদ্যুৎকেন্দ্রের চুল্লিকে কেন্দ্র করে বিশাল এলাকা নিয়ে স্থায়ী সাদা মেঘের মতো ধোঁয়ার আস্তরণ তৈরি হয়েছে। এই ক্ষতি মেনে নিয়ে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করেছে জার্মান, কারণ এর আশপাশে সুন্দরবনের মতো বিশেষ কোনও বন নেই। সংরক্ষিত কোনও অঞ্চল নেই। জনবসতিও নেই। এই এলাকায় ফসল না হলেও তাদের কোনও সমস্যা হয় না। বহু অনাবাদী জমি এখনও তাদের পড়ে আছে। জার্মানির সঙ্গে বাংলাদেশের কোনও তুলনা চলে না। তুলনা চলে না ভারতের সঙ্গেও। ভারত শুধু সুন্দরবন না যেকোনও বনাঞ্চলের ২৫ কিলোমিটারের মধ্যে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করতে পারে না। অথচ বাংলাদেশে এসে সুন্দরবনের ১০ কিলোমিটারের মধ্যে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করছে।
৮. ২০০ বছর আগে সুন্দরবনের মোট আয়তন ছিল প্রায় ১৭ হাজার বর্গ কিলোমিটার বর্তমানে যা দাঁড়িয়েছে ১০ হাজার কিলোমিটারে। এর ৬০% বাংলাদেশে, ৪০% ভারতের পশ্চিমবঙ্গে।
সুন্দরবনকে বলা হয় ‘ইউনিক’ বন। অর্থাৎ সুন্দরবন পৃথিবীতে একটিই। সুন্দরবনের ‘ইউনিক’ ব্যাপারটা কী? ‘ইউনিক’ বিষয়টি হলো, সুন্দরবনের পরাগায়ন হয় মৌমাছি ও প্রজাপতির মাধ্যমে। মৌমাছি, প্রজাপতির জন্যে ভয়ঙ্কর ক্ষতির কারণ বিষাক্ত কার্বন-সালফার-নাইট্রোজেন, ধোঁয়া-ছাই মিশ্রিত বিষাক্ত ধোয়া।
রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ হলে একদিনে বা পাঁচ-দশ-বিশ বছরে সুন্দরবন ধ্বংস হয়ে যাবে না। বাঘ, হরিণ, অন্যান্য প্রাণীও এই সময়ের মধ্যে মারা যাবে না। আস্তে আস্তে সুন্দরবনের মৌমাছি, প্রজাপতির সংখ্যা কমে যাবে। এক সময় বিলুপ্ত হয়ে যাবে। সুন্দরবনের পরাগায়ন কমতে থাকবে, বন্ধ হয়ে যাবে। এক সময় সুন্দরবনই আর থাকবে না। বন না থাকলে বাঘ, হরিণ, পাখি, কুমির, মাছ… কিছুই থাকবে না। এমন অবস্থা দৃশ্যমান হতে হয়তো ৩০, ৪০ বা ৫০ বছর লাগবে।
যারা বলেন, লাখ লাখ ব্যারেল তেল পড়েও তো সুন্দরবনের ক্ষতি হলো না, তাদের বনের ক্ষতির বিষয়টি আগে বুঝতে হবে। কোনও বনের ক্ষতি একদিনে হয় না। ক্ষতি হয় দীর্ঘ সময় নিয়ে। তা বোঝা যায় অনেক বছর পরে।
৯. সুন্দরবনের ক্ষতি হবে কী হবে না- এই আলোচনা থেকে তা না বোঝার কারণ নেই, বোঝার জন্যে বিশেষজ্ঞ হওয়ারও প্রয়োজন নেই। সুন্দরবনের ক্ষতি হবে না, বাতাস সুন্দরবনের দিকে যাবে না- এই অসত্য, স্থূল বক্তব্যগুলো অত্যন্ত শ্রুতিকটু।
বিতর্ক নয়, আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে, আমরা ১৩০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ চাই, নাকি সুন্দরবন চাই? দু’টোই একসঙ্গে চাওয়ার কোনও সুযোগ নেই। কথা সর্বস্ব রাজনৈতিক গোঁড়ামি দিয়ে ‘সম্ভব’ করতে চাইলে, সেটা আলাদা বিষয়। সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে বিবেচনা প্রত্যাশিত, বিদ্যুৎকেন্দ্র ১০০টি জায়গায় ১০০টি নির্মাণ করতে পারব। একটি সুন্দরবন বাংলাদেশের ভেতরে তো নয়ই, পৃথিবীর কোথাও কেউ তৈরি করতে পারবে না।
লেখক: সম্পাদক, সাপ্তাহিক
# | Cases | Deaths | Recovered |
---|---|---|---|
World | 0 | 0 | 0 |
Bangladesh | 0 | 0 | 0 |
Data Source: worldometers.info |
সানি সানওয়ার কাজ করেন নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ নিয়ে। স্বপ্ন দেখেন কার্বন নিঃসরণমুক্ত বিদ্যুৎ–ব্যবস্থার। ...
বিস্তারিতধরুন আপনার অসাধারণ কিছু প্রোডাক্ট আছে। খুব সুন্দর করে কন্টেন্ট তৈরী করে নিজের ওয়েবসাইট সাজিয়েছেন। পণ্যের ছবি ...
বিস্তারিতআজকে যে বিষয়টা দিয়ে আলোচনা শুরু করতে চাই, সেই ধারণাটার জন্ম স্ট্রিং তত্ত্ব থেকে। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, এর ...
বিস্তারিতফেসবুক ব্যবহারের কারণে মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষতির বিষয়টি প্রায় সবাই জানেন। এর সঙ্গে ব্যক্তিগত তথ্যের ...
বিস্তারিত